দেশের পূর্বাঞ্চলের ধানের সবচেয়ে বড় বাজার আশুগঞ্জ মোকামে সরেজমিনে ইউএনবি প্রতিনিধি দেখেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন আশুগঞ্জ মোকাম ঘাটে হাজার হাজার মণ বোরো ধান আসছে। প্রতিদিন এখানে বিপুল পরিমাণ ধান কেনাবেচা হয়। হাওর অঞ্চল হিসাবে পরিচিত কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, নরসিংদী থেকে নদীপথে কৃষকরা ধান নিয়ে আসছেন। এখান থেকে সরাসরি ধান ক্রয় করেন মিল কারখানার মালিকরা।
প্রতিদিন ধানের চাহিদার ওপর নির্ভর করে ধানের বাজার মূল্য। এবার বোরো মৌসুমে হাওর অঞ্চলে বৈশাখ মাসে শুরুতে শিলা বৃষ্টির কারণে ধানের জমির কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তারপরও ফলন ভালো হয়েছে।
কৃষকরা বলছেন, ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এবছরও তারা বড় আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন। কারণ প্রতি একর জমিতে ধান চাষ করতে যা খরচ হয়, তা ধান বিক্রি করে তার অর্ধেকও খরচ উঠে আসে না। দিন মজুরের পারিশ্রমিকসহ প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ প্রায় এক হাজার টাকা। অথচ এক মণ ধানের বর্তমান বাজার দর মাত্র ৫৫০ থেকে ৭৫০ টাকা।
সরাইল উপজেলার অরুয়াইল গ্রামের কৃষক রমজান বলেন, দিনমজুরকে প্রতিদিন বেতন দিতে হয় ৬০০ টাকা। এছাড়া তাকে আবার খোরাকি দিতে হয় অতিরিক্ত ২০০ টাকা। সবকিছু মিলিয়ে খরচ হয় প্রায় এক হাজার টাকা। উৎপাদন খরচ না উঠায় তার এক মণ ধানে লোকসান হচ্ছে প্রায় ৩০০ টাকা।
হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘গত তিন দিন ধরে ১,৪০০ মন ধান নিয়ে তিনি আশুগঞ্জ মোকাম ঘাটে নৌকা ভিড়িয়েছেন। শুধুমাত্র এ নৌকাতেই লোকসান হবে প্রায় চার লাখ টাকা। বাধ্য হয়েই লোকসানে ধান বিক্রি করতে হবে।’
কিশোরগঞ্জের নিকলী গ্রামের আরেক কৃষক জানান, তার নৌকাতে ৮০ হাজার টাকা লোকসান হবে।
এমনিভাবে একাধিক কৃষক জানান, তাদের লোকসানের কথা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দেশের পূর্বাঞ্চলের ধানের সবচেয়ে বড় বাজার আশুগঞ্জ মোকামে প্রতিদিন ৫০ হাজার মণ ধান আমদানি হচ্ছে। ধানের দরপতনের কারণে প্রায় প্রত্যেক কৃষককেই গুণতে হচ্ছে লোকসান। এ নিয়ে কৃষকের মধ্যে হাহাকার চলছে।
কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, সরকার প্রতি মন ধানের মূল্য নির্ধারণ করেছে এক হাজার ৪০ টাকা। কিন্তু তাদের বাধ্য হয়ে পাইকারদের কাছে ৫২০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। সে হিসেবে গড়ে প্রায় ৩০০ টাকা করে মণ প্রতি লোকসান হচ্ছে কৃষকের। ফলে প্রতিদিন এ মোকামে কৃষকদের দেড় কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।
তবে সরকারি ক্রয় কেন্দ্র না থাকায়, অনেকটা না জেনেই কম মূল্যে কৃষক ও পাইকাররা ধান বিক্রি করে থাকে।
এ বিষয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সুবীর নাথ চৌধুরী জানান, প্রতিটি উপজেলায় খাদ্য গুদাম থাকায় মোকামে ক্রয়কেন্দ্র খোলার উপযোগিতা এখন নেই। কৃষক সরাসরি গুদামে ধান বিক্রি করলে ন্যায্য মূল্য পাবে।
জেলা চাল কল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ বললেন, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বিদেশ থেকে চাল আমদানি বন্ধের পাশাপাশি সরকারের ক্রয়কৃত চালের পরিমাণ দ্বিগুণ করতে হবে। এছাড়া আশুগঞ্জ মোকামে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করার সরকারি ক্রয়কেন্দ্র চালুর দাবি জানান তিনি।
আশুগঞ্জ খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ৩৩ হাজার ৯শ’ ২৩ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা হবে। এর মধ্যে সিদ্ধ চাল ২৪ হাজার ৪শ’ ৩৭ মেট্রিক টন ও আতব চাল ৯ হাজার ৪শ’ ৮৬ মেট্রিক টন।
আশুগঞ্জ মোকাম থেকে ২২ হাজার ৯০ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করবে আশুগঞ্জ খাদ্য গুদাম। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৩৮২ মেট্রিক টন সিদ্ধ ও ৬ হাজার ৭০৮ মেট্রিক টন আতব চাল সংগ্রহ করা হবে। চালের মূল্য ধরা হয়েছে সিদ্ধ ৩৬ টাকা ও আতব চালের মূল্য ধরা হয়েছে ৩৫ টাকা কেজি। আশুগঞ্জে মোট ২৪৬টি মিলের সাথে চুক্তি করা হয়েছে। চাল সংগ্রহ অভিযান চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।
এদিকে দেশের অধিকাংশ অঞ্চলেই এবছর বোরো ধানের দরপতনের খবর পাওয়া গেছে।
টাঙ্গাইল, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় ন্যায্য মূল্য না পেয়ে আগুন দিয়ে ধান পুড়িয়ে ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ জানাচ্ছে বিক্ষুব্ধ সাধারণ কৃষকরা।
উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও কৃষকদের আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে।